জলোচ্ছ্বাসের তোড়ে চোখের সামনে শ্যাওলার মতো ভেসে যাচ্ছে নারী-পুরুষ-শিশু আর গবাদি পশুর লাশ। স্রোতের তোড়ে নিশ্চিত মৃত্যুর দিকে ভেসে যেতে থাকা মানুষের গোঙানির শব্দ আজও কানে বাজে। প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় আর বঙ্গোপসাগরের সর্বগ্রাসী লোনাজলের সঙ্গে রাতভর লড়াই করে সত্যিই মৃত্যুকে খুব কাছ থেকে দেখেছিলাম সে রাতে। নিহতের সংখ্যা বিচারে স্মরণকালের ভয়াবহতম সেই ঘূর্ণিঝড় ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিল বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব চট্টগ্রাম বিভাগের উপকূলীয় অঞ্চলে ঘণ্টায় প্রায় ২৫০ কিলোমিটার গতিবেগে আঘাত হানে। প্রায় ৬ মিটার বা ২০ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাসে উপকূলীয় এলাকা প্লাবিত হয়ে প্রায় ১ লাখ ৩৮ হাজার মানুষ নিহত হয় এবং প্রায় ১ কোটি মানুষ সাময়িকভাবে বাস্তুচ্যুত হয়ে তাদের সর্বস্ব হারায়।
তখন চলছিল গ্রীষ্মের খরা। বিল-খাল ফেটে চৌচির। সেই দিনটি ছিল সোমবার। দুদিন আগেই নিম্নচাপের সংকেত দিয়েছিল আবহাওয়া অধিদপ্তর। রবিবার রাতেই নিম্নচাপটি ঘূর্ণিঝড়ে রূপ নেয়। আবহাওয়া অধিদপ্তর থেকে জানানো হয় ৬ নম্বর বিপদসংকেতের সতর্কবার্তা। ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে সোমবার সকাল থেকেই আকাশ ছিল মেঘাচ্ছন্ন। হালকা বাতাস বইছিল। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি পড়ছিল, তবু ভ্যাপসা গরম কাটছিল না। দুপুরের পর থেকে ক্রমেই বাড়তে থাকে বাতাসের গতিবেগ।
আমি তখন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে সদ্য ভর্তি হওয়া ছাত্র। ঘূর্ণিঝড়ের ঠিক আগের দিন ছুটিতে ফিরেছি চট্টগ্রামের আনোয়ারা উপজেলার রায়পুর গ্রামে আমাদের বাড়িতে। আমাদের বাড়ি থেকে মাত্র দেড় কিলোমিটার পশ্চিমে বঙ্গোপসাগর আর আড়াই কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে শঙ্খ নদী। উপকূলীয় বেড়িবাঁধের অবস্থা ছিল অত্যন্ত নাজুক। ভাঙনের কারণে অনেক জায়গায় বাঁধের অস্তিত্বই ছিল না। বলতে গেলে, এগারোটি গ্রাম নিয়ে গঠিত রায়পুর ইউনিয়ন ছিল পুরোপুরি অরক্ষিত। তবে ঝড়-জলোচ্ছ্বাস আর সাগরের ঢেউয়ের সঙ্গে নিত্যপরিচিত উপকূলীয় মানুষের মধ্যে এ নিয়ে কোনো ধরনের ভীতি কিংবা আতঙ্কের লেশমাত্র ছিল না।
মাটির দেয়াল আর ওপরে টিনের চাল দেওয়া ঘরে ছিলাম আমি, মা ও আমার ভাগনি বিলকিস। বিকেল ৫টার পর থেকে আরও বেড়ে যায় বাতাসের গতি, একই সঙ্গে বৃষ্টিও। সন্ধ্যার আঁধার নেমে আসার পর শুরু হয়ে যায় ঝড়োহাওয়ার ঝাপটা। মাঝেমধ্যে দমকা হাওয়ায় মনে হচ্ছিল যেন টিনের চাল উড়ে চলে যাবে। এ অবস্থার মধ্যেই আম্মা রান্নাবান্না শেষ করে ফেলেন। কিন্তু খাওয়া হয়নি কারোরই। রাত ৯টার দিকে জ্যাঠাতো ভাই আবুল কালাম ঝড়বৃষ্টির মধ্যেই এসে আম্মাকে জানালেন ১০ নম্বর মহাবিপদ সংকেতের কথা। অনুরোধ করলেন সাইক্লোন শেল্টার কিংবা দূরে কোথাও চলে যেতে। কিন্তু আম্মা রাজি হলেন না। বললেন, বিল-খাল শুকনো। পানি এলে তা তো জমিনই চুষে নেবে। আশপাশের বাড়িঘরের অনেকেই এ সময় পরিবারের সদস্যদের নিয়ে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে গেলেও আমরাসহ ১১টি পরিবারের সদস্যরা থেকে গেলাম নিজ নিজ ঘরে। সাড়ে ১০টার দিকে প্রচণ্ড গতিতে বইতে শুরু করল ঝড়। ঝড়োহাওয়া আর বর্ষণের শব্দ ছাড়া আর কিছুই শোনা যাচ্ছিল না তখন। মনে মনে ভয় লাগলেও ভরসা দিচ্ছিলেন আম্মা। হারিকেন জ্বালিয়ে এক ঘরে বসে রইলাম আমরা তিনজন। মাঝেমধ্যে মনে হচ্ছিল দমকা হাওয়া হয়তো আমাদের ঘরটিই উড়িয়ে নিয়ে যাবে।
রাত ১২টার দিকে জানালা ফাঁক করে বাইরে টর্চলাইটের আলো ফেলতেই দেখি ঘরের দেয়ালের কাছেই পানি। তড়িঘড়ি করে আম্মা আর ভাগনিকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম ঘর থেকে। আমার ডাকাডাকিতে পাঁচ বছরের ছেলে বাদশা আর তিন বছরের মেয়েকে নিয়ে বেরিয়ে এলো জ্যাঠাতো ভাই ফয়েজ ও তার স্ত্রী। এলেন জ্যাঠাতো বোন আয়েশা, তার স্বামী সত্তরোর্ধ্ব আছদ আলী ও মেয়ে ফাতেমা। বাড়ির উঠোনে তখন কোমরসমান পানি। সবাই মিলে পানি ভেঙে ভিটের উত্তর-পূর্ব পাশে থাকা খড়ের গাদায় গিয়ে উঠলাম। প্রথম দফায় শঙ্খের বাঁধ বিলীন হয়ে দক্ষিণ-পূর্ব থেকে ধেয়ে আসা পানি দ্রুত বাড়ছিল তখন। এ অবস্থায় আমরা একে অপরকে জড়িয়ে রেখে একসঙ্গে জীবন বাঁচানোর সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছিলাম। কিন্তু বেশিক্ষণ টিকে থাকতে পারিনি। রাত সাড়ে ১২টায় দ্বিতীয় দফায় বঙ্গোপসাগর থেকে উঠে আসা জলোচ্ছ্বাসের ঢেউয়ের আঘাতে টুকরো টুকরো হয়ে ছিঁড়ে যায় খড়ের গাদাটি। আমার চোখের সামনেই অল্প খড়সহ বিচ্ছিন্ন হয়ে ভেসে গেলেন আম্মা ও ভাগনি বিলকিস। তাদের ধরে রাখার কোনো চেষ্টাই কাজে এলো না। একইভাবে একে একে ভেসে গেলেন আয়েশা ও তার স্বামী আছদ আলী। ছেলে বাদশা আর মেয়ে মুন্নিকে কাঁধে নিয়ে খড় ধরে ভেসে গেলেন জ্যাঠাতো ভাই ফয়েজ। বাকি রইলাম আমি, ফয়েজের স্ত্রী ও ফাতেমা।
প্রাণের মায়া তখনো ছাড়িনি। হঠাৎ দক্ষিণ দিক থেকে একটি খালি চালা এসে ঠেকল খড়ের গাদা ও পাশের ফুলগাছের সঙ্গে। আমরা তিনজনই তাতে উঠে পড়লাম। দশ মিনিটের মতো ওই অবস্থায় ছিলাম। এরপর হঠাৎ পানির প্রচণ্ড স্রোত আমাদেরসহ চালাটি ভাসিয়ে নিয়ে যেতে লাগল পূর্বদিকে। প্রায় আধকিলোমিটার যাওয়ার পর চালা থেকে ছিটকে পড়ে গেলাম আমি। মনে হলো এখানেই জীবন শেষ, বাঁচার আশা প্রায় ছেড়ে দিলাম। এমন সময়ই হঠাৎ ভেসে উঠলাম পানির ওপরে। ঝড়ে ডালপালা ভেঙে গিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা একটা কড়ইগাছ পেলাম সামনে। শক্ত করে জড়িয়ে ধরলাম গাছটি। এক-একটি ঢেউ এসে চলে যাচ্ছিল মাথার ওপর দিয়ে। গাছটি জড়িয়ে ধরে ঢেউয়ের ধাক্কার মুখে অনেক কষ্টে নিজেকে টিকিয়ে রাখছিলাম। ঢেউ যাওয়ার পর
মাথাটা কোনোভাবে পানির ওপর তুলে নিঃশ্বাস নিচ্ছিলাম। গাছটির ডালপালা না থাকায় আরও ওপরে ওঠার কোনো সুযোগ ছিল না। তখন গভীর রাত। পানির নিচে ডুবে গেছে পুরো উপকূলীয় এলাকা। চারদিকে শুধু পানি আর পানি। মনে হচ্ছিল যেন সাগরমাঝে ভাসছি আমি। ঘরের চালা, গাছপালা, খড়কুটো ইত্যাদি স্রোতের টানে চলে যাচ্ছিল আমার কাছ দিয়েই। পানিতে ভাসতে থাকা এক মহিলাকে দেখলাম গোঙাতে গোঙাতে এসে ঠেকেছে একটু দূরে আরেকটি গাছের সঙ্গে। কিন্তু এ সময় গাছটি ধরে বাঁচার চেষ্টা করার মতো শক্তিও সম্ভবত তার ছিল না। কিছুক্ষণ পর সেখানেই তাকে নিথর হয়ে ভাসতে দেখলাম। এভাবে অনেক আদম সন্তানের লাশ ভেসে যেতে দেখেছি খুব কাছ থেকে। এভাবে ঝড় আর ঢেউয়ের সঙ্গে লড়াই করেই কাটে সারাটা রাত।
রাত আনুমানিক ৩টার পর থেকে পানি কমতে শুরু করে। পানি কমে যাওয়ার পর সকাল ৭টার সময় নেমে আসি রাতভর বুকে জড়িয়ে রাখা গাছটি থেকে। তখনো বুকসমান পানি। পানি সাঁতরে কোনোভাবে উঠে এলাম বাড়ির সামনের রাস্তায়। এ সময় রাস্তার দুপাশে দেখা যাচ্ছিল কেবল লাশ আর লাশ। চিৎ, কাত, উপুড় হয়ে পড়ে থাকা বিবস্ত্র নারী-পুরুষের লাশ, সন্তান বুকে মায়ের লাশ, গরু-ছাগলের অসংখ্য মরদেহ। চোখের সামনে ভেসে যাওয়া আম্মা-ভাগনি, প্রতিবেশী কারও বেঁচে থাকার আশাই করতে পারছিলাম না তখন। ভিটেতে ফিরে দেখি ঘরের কোনো অস্তিত্বই নেই। শূন্য ভিটেয় ভেজা কাপড়ে বসে কাঁদছেন আম্মা! আম্মা জানালেন, খড়সহ ভেসে যাওয়ার পথে একটি গাছ ধরে রাতভর মৃত্যুর সঙ্গে যুদ্ধ করে বেঁচেছিলেন তিনি। একইভাবে বেঁচে যান ভাগনি বিলকিসও। কিন্তু চিরদিনের জন্য হারিয়ে যায় জ্যাঠাতো ভাই ফয়েজ, তার ছেলে বাদশা, মেয়েসহ আমাদের বাড়ির তিনটি পরিবারের ১৬ জন সদস্য। অনেক খোঁজাখুঁজির পর মেলেনি এদের কারোর লাশের সন্ধান। ২৮ বছর আগের সেই ভয়ংকর স্মৃতি আজও নাড়া দিয়ে যায়। ভাবলেই বিস্মিত হই কীভাবে বেঁচে গিয়েছিলাম সে রাতে! রাতটির কথা ভাবলে এখনো মনে হয়, প্রায় দেড় লাখ মানুষের মতোই আমার জীবনও তো সেই আটাশ বছর আগেই থেমে যেতে পারত। এখনো যে বেঁচে আছি সেটা তো ‘বোনাস লাইফ’!
লেখক :শামসুল ইসলাম, জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক, চট্টগ্রাম ব্যুরো, দেশ রূপান্তর
(লেখাটি জাতীয় দৈনিক দেশ রূপান্তর পত্রিকা থেকে সংগৃহীত)
বাংলাদেশ সময়: ১০:৫২ অপরাহ্ণ | মঙ্গলবার, ২৮ এপ্রিল ২০২০
ekhonbd24.com | saidul islam
Development by: webnewsdesign.com